হেফাজতে ইসলাম সরকারের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করলেও তাদের আর কোনো ধরনের ছাড় দিতে রাজি নয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
বিভিন্ন ইস্যুতে সন্ত্রাসী (তাণ্ডব) কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান ও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া অব্যাহত রাখা হবে।
 
পাশাপাশি ধর্মকে ব্যবহার করে নতুন করে যেন কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকবে সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এই ইস্যুতে ধর্ম ও দেশের আলেম সমাজকে কোনোভাবেই নিজেদের প্রতিপক্ষ বানাতে চায় না ক্ষমতাসীনরা। এক্ষেত্রে ‘সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে’-এমন নীতি অনুসরণ করছেন তারা।
 
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বৃহস্পতিবার বলেন, ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
 
সেটা হেফাজতই হোক আর জামায়াত-বিএনপিই হোক। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে। ধর্মের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু ধর্মকে যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। ধর্মকে যারা ঢাল বানাতে চায়, তাদের সঙ্গে আমাদের বিরোধ। কারণ আমরা সব ধর্মের সমান অধিকারে বিশ্বাস করি।
 
একই বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না। যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
 
তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে হেফাজতের কতিপয় অপরাধারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া মানে দেশের আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া নয়। তিনি আরও বলেন, জামায়াত, বিএনপি ও হেফাজত ইসলাম একই সূত্রে গাঁথা। এরা দেশ, স্বাধীনতার জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে। তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়। তাই যুদ্ধাপরাধীদের যেভাবে বিচার করা হয়েছে, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে এদেরও সেভাবে বিচার করা উচিত।
 
গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি থেকে সরকারি অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, ব্যাপক সহিংসতা ও ধ্বাংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। এই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার রাতে হেফাজতের কয়েকজন নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে তার বাসায় দেখা করেন। জানা গেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হেফাজতের নেতারা মূলত নিজেদের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে দাবি করে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করেছেন। তারা বলার চেষ্টা করেছেন- তাদের কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। এ সময় তারা নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধের দাবি জানান। তবে ওই সাক্ষাতের পরে সরকার ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, এই সাক্ষাৎ অপরাধীদের গ্রেফতার অভিযানের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।
 
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, সরকারের সঙ্গে কেউ দেখা করতে চাইলে, দেখা করতেই পারে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেখা করেছেন। কিন্তু তাতে দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো ব্যত্যয় হবে না।
 
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম মহাসমাবেশের নামে যখন ঢাকা শহরে তাণ্ডব চালিয়েছিল, সে সময় সরকার কঠোর হাতে তাদের মোকাবিলা করেছিল। তবে এরপর সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। সেই সময় সরকার হেফাজতের দাবি মেনে কওমি শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেয়। কওমি মাদ্রাসা বোর্ড গঠনের জন্য আইন করে। কওমি শিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মর্যাদা পায়। কিন্তু এত প্রাপ্তির পরও হেফাজতে ইসলাম তাদের ‘সাম্প্রদায়িক চরিত্র’ বদলাতে পারেনি। গত বছরের শেষের দিকে হেফাজতে ইসলামসহ আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন রাজধানীর দোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ বন্ধের দাবি তোলে। এর মধ্যেই ৪ ডিসেম্বর রাতে কুষ্টিয়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
 
আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই মনে করেন, হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সরকারের শক্ত অবস্থান অব্যাহত রাখা উচিত ছিল। বিশেষ করে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের ঘটনার পর তাদের আরও কঠোরভাবে প্রতিহত করা দরকার ছিল। সে সময় তাদের ছাড় দেওয়া হয়েছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ। আর এই ছাড় দেওয়ার কারণেই হেফাজত এখন নতুন নতুন অপকর্ম করার সাহস দেখাচ্ছে। ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতারাও হেফাজতে ইসলাম ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে কঠোর অবস্থানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই।
 
সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ১৪ দলের এক আলোচনা সভায় বলেছেন, নীতির প্রশ্নে শক্তভাবে দাঁড়ালে কোনো অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। ২০১৩ সালের ৫ মে তাণ্ডবের পরই হেফাজত প্রশ্নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ছিল। ভার্চুয়াল ওই একই আলোচনা সভায় জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজত এবং এসব জঙ্গি দল একই সূত্রে গাঁথা। হেফাজতিদের বসে রাখার কৌশলটাও ভ্রান্ত কৌশল। দুধ দিয়ে সাপ পুষে লাভ নেই। সাপ ছোবল মারবেই। তাই আমি মনে করি যুদ্ধ মোকাবিলা করে বিজয় অর্জন করতে চাইলে এই কৌশলটা পরিহার করা উচিত।
 
ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নীতিনির্ধারক প্রায় অভিন্ন মন্তব্য করে বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, হেফাজত ইস্যুতে আওয়ামী লীগ দেশের আলেম সমাজকে বা কওমি মাদরাসা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সবাইকে নিজেদের প্রতিপক্ষ বানাতে চায় না। ফলে এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
 
অর্থাৎ একদিকে বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, অন্যদিকে সাধারণ মুসলমান বা আলেমদের মধ্যে যেন ভুল বার্তা না যায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকা।
 
এ বিষয়ে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোনো দল বা আলেম-ওলামা দেখে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। যারা এ তাণ্ডবলীলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, বাড়িঘরে হামলা ও আগুন দিয়েছে, তাদের ভিডিও দেখে গ্রেফতার করা হয়েছে।